আজ শনিবার, ২৭শে পৌষ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

কামাল মৃধা কোথায় ?

বিশেষ প্রতিবেদক
একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে একটা হৈচৈ ফেলে দেন কামাল মৃধা। দলীয় মনোনয়ন চাওয়ায় তাকে নিয়ে দলের ভেতর ও বাইরে আলোচনা সমালোচনা শুরু হয়। কারও মতে, তিনি দলছুট নেতা। ফের ফিরে বিভেদ সৃষ্টি করছেন। তবে সেসময়ের ঘটনা টেনে কয়েকজন নেতা জানান, ওসমান বলয়ের মামলা হামলার শিকার হয়ে দল ছেড়েছিলেন তিনি। পক্ষে বিপক্ষের এসব টানাটানির মধ্যেই আওয়ামী লীগের উপর মহলে একবার প্রশ্ন উঠেছিলো,‘কামাল মৃধা কোথায়’।
১৯৮১ সালে সরকারী তোলারাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন কামাল মৃধা। ওই বছর তার কাছে কলেজ ছাত্র-ছাত্রী সংসদের নির্বাচেন আন্ত:ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক পদে মনোনয়ন জমা দিয়েছিলেন শামীম ওসমান। ভিপি পদে নির্বাচন করার কথা ছিলো কামাল মৃধার। তবে হঠাৎ করে রাতের আঁধারে উলটে যায় সব। আন্ত:ক্রীড়া সম্পাদক পদে মনোনয়ন চাওয়া শামীম ওসমানকে দেয়া হয় ভিপি পদ। প্রবীণ কয়েকজন রাজনীতিক জানান, এরপর থেকে কামাল মৃধা হয়ে উঠেন শামীম ওসমানদের চক্ষুশুল।
সূত্র জানায়, ‘৯১’র বিএনপি সরকারের আমলে শহরে প্রভাব ছিলো শামীম ওসমানের। ওই সময়ে দলে তার প্রতিপক্ষ ছিলো শহরের দক্ষিণপন্থিরা। যুবলীগের নেতা খাজা রহমতউল্লাহ (জাতীয় হকি তারকা খেলোয়াড় ও সংগঠক), জাহাঙ্গীর আলম, কামাল মৃধা তার শক্ত প্রতিপক্ষ ছিলো। তাদের দমাতে চাষাঢ়া খাজা সুপার মার্কেটের একটি ভিডিও দোকানে কথিত ভাংচুর ঘটনায় সদর থানায় মামলা করা হয়। তখনকার পুলিশের এক কর্মকর্তাকে ম্যানেজ করে এ মামলার আসামী করা হয় কামাল মৃধা, খাজা রহমতউল্লাহ, জাহাঙ্গীর আলম, জিএম আরাফাত, শান্তদের বিরুদ্ধে। ওই মামলার রায়ে খাজা রহমতউল্লাহর ১২ বছর, জাহাঙ্গীর আলমের ১০ বছর, জিএম আরাফাত ও শান্তর ৮ বছর করে এবং কামাল মৃধার ৭ বছর সাজা হয়। নিজের এবং দলের নেতাদের বাঁচাতে একাধিক আওয়ামী লীগের নেতার সাথে কথা বলেন কামাল মৃধা। তাদের মধ্যে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ডা. শাহাদাৎ হোসেন, শেখ মিজানুর রহমান, গোলাম মোর্শেদ ফারুকী, দেওভোগের আলম চান মুন্সি, আব্দুর রহমান, আনোয়ার হোসেন, সমীর ভদ্র, শেখ হায়দার আলী পুতুল, আব্দুল কাদির অন্যতম। পরামর্শ করে ঠিক করা হয় কামাল মৃধা বিএনপিতে যোগ দিবে। এরপর তিনিসহ সব নেতাদের মামলা থেকে রেহাই পাওয়ার এ কৌশল অবলম্বন করা হয়। প্রবীণ এক রাজনীতিক জানান, তার এ বুদ্ধির পক্ষে সমর্থন ছিলো আওয়ামী লীগের অনেক ঝানু রাজনীতিকের। তিনি আরও জানান, যুবলীগ নেতাদের সাজা মাফ করার বিএনপি সরকারের তৎকালিন রাষ্ট্রপতির কাছে মার্সি পিটিশন করা হয়। তখনকার স্বরাস্ত্রমন্ত্রী আব্দুল মতির চৌধুরী কামাল মৃধার শ্বশুড়পক্ষের আত্মীয় হওয়ায় এ কাজ সহজ হয়। কামাল মৃধা অনুসারীদের মতে, এ কারনে তাকে সংবর্ধিত না করে উল্টো কামাল মৃধার বদনাম করছে সেই মামলার আসামী সহ কেউ কেউ।
আওয়ামী লীগ নেতা সমীর ভদ্র এ প্রতিবেদককে জানান, কামাল মৃধা আমি সহ অনেক আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে কথা বলেই বিএনপিতে যোগ দেয়। তার কারনেই চাষাঢ়ার পক্ষের করা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়েও রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পান খাজা রহমতউল্লাহ, জাহাঙ্গীর আলম, জিএম আরাফাত, শান্ত, কামাল মৃধা । তিনি আরও জানান, এ মামলাটি সাজানো ছিলো।
কলেজে ভিপি পদে এগিয়ে থেকেও যেমন বাদ পড়েছেন তেমনি ‘৮৫ সালে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হতে গিয়েও হতে পারেননি। এসময় পাইকপাড়ার জাহাঙ্গীর আলমকে সভাপতি করা হয়েছিলো। দলের একাধিক নেতা জানান, চৌকস হওয়ার কারনে পৌর পিতা আলী আহাম্মদ চুনকা কামাল মৃধাকে খুব পছন্দ করতেন আর এ কারনে ওসমান বলয় তাকে কোনঠাসা করতে ব্যস্ত থাকতো। মামলা দিয়ে ঘায়েল করতে না পেরে ‘৯৬’র আওয়ামী লীগের আমলে তার শারিরীক আঘাত হানে ওসমান বলয়ের ক্যাডাররা। ঢাকা নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডে কড়ইতলা এলাকায় গাড়ি থেকে নামিয়ে কামাল মৃধাকে বস্তায় ভরে হকি স্টিক দিয়ে পেটানো হয়। অকর্থ নির্যাতনের ফলে তার হাড়গোড় ভেঙ্গে যায়। অনেক দিন দেশে ও দেশের বাইরে চিকিৎসা নেন তিনি। এরপর চলে যান দেশের বাইরে।
স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সাহসী নেতা ও নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান জানান, ওসমানদের লোকেরা কামাল মৃধার উপর যে পরিমান অত্যাচার করেছে তা অনেকেই সহ্য করতে পারতেন না। তিনি জানান, কামাল মৃধা বরাবরই একজন চৌকস সংগঠক। তিনি বিএনপিতে গিয়ে নিজের এবং দলের লোকের মামলার সাজা রাষ্ট্রপতির ক্ষমার মধ্য দিয়ে শেষ করেছিলেন। এ বিষয়টি তখন অনেকের সাথেই আলাপ করে কামাল মৃধা পরামর্শ নিয়েছিলেন।
এদিকে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার মতে, কামাল মৃধা ভালো মানুষ নন। তিনি বিএনপিতে চলে গেছেন আবার আওয়ামী লীগে এসে সুবিধা ভোগ করতে চাইছেন। সম্প্রতি মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ চাওয়ায় কামাল মৃধার উপর অনেকে রুষ্ট। উত্তর মেরু বরাবরের মতোই তার বিরোধী এবার তার সাথে যোগ হয়ে দক্ষিণ অংশের কেউ কেউ। তাদের মতে, কামাল মৃধার রাজনৈতিক কোন আদর্শ নেই।
তবে কামাল মৃধার অনুগতরা বলছেন, বিএনপিতে গেলেও বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হননি কামাল মৃধা। তিনি মামলা থেকে সবাইকে বাঁচানোর জন্য দল ত্যাগ করেছিলেন। এ কাজ শেষে তিনি বিদেশে চলে যান। তাদের মতে, আওয়ামী লীগের হাই কমান্ডে গ্রহনযোগ্যতা রয়েছে কামাল মৃধার। তাই আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় অর্থ ও পরিকল্পনা বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য পদ দেয়া হয়েছে তাকে। যে কমিটির সভাপতি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থ উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুন্সিও এ কমিটিতে রয়েছেন।
কামাল মৃধার বিয়ের অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রি শেখ হাসিনা এসেছিলেন। দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৬ সালের নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের আগে নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকে ঢাকায় ডেকেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেলিনা হায়াৎ আইভী, শামীম ওসমান, আনোয়া হোসেন সহ কয়েকজন সেখানে যান। ওই সময় শেখ হাসিনা বলেছিলেন, সবাইতো এলেন, কামাল মৃধা কোথায় ?